"আমি ঠিক সময়েই ফিরেছি। সন্ধ্যাটাই আসতে একটু দেরি করেছে।"
গল্পকথনে কল্লোল দা'র কন্ঠে সুবোধ ঘোষের 'শুন বরনারী' শুনেছিলাম। সে অনেক দিন আগের কথা। লেখকের সাথে এভাবেই প্রথম পরিচয়। আর কি? সুবোধ ঘোষের লেখার গুণগ্রাহী হয়ে গেলাম। কি চমৎকার যে এই মানুষটা লেখেন!
ঈদের আগের দিন হবে বোধ হয়। ছুটিতে পড়বো দেখে কিছু বই কিনবো। ছুটে গেলাম নীলক্ষেত। শাহজাহান মামার দোকানে। পুরোনো বই কিনবো। যেয়ে দেখি মামা নামাজ পড়তে গিয়েছেন। ওদিকে বৃষ্টি! আবার শুধু যাতায়াত ভাড়াটাই ব্যাগে ছিল। বই কেনার টাকা বিকাশে। বিকাশের দোকান বন্ধ।
মামা আসলেন। এই কোনা সেই কোনা থেকে আমার মনমত সব বই বের করলেন। ঠিক জানেন, কেমন বই খুঁজছি। নিজেই গিয়ে এক বিকাশের দোকানদারকে দিয়ে দোকান খুলালেন। এগারোটা বই নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। মামা আবার বলে দিলেন, উনি আমার পছন্দসই সব বই রেখে দিবেন, আমি যাতে এইদিন আবার আসি। বইগুলো সবসময় পাওয়া নাকি মুশকিল! মুশকিলই বটে! পুরোনো বই ভালোবাসি আম। এবার যেগুলো আনলাম সেগুলোর অবস্থা বেশ খারাপ ই বলা যায়। জোড়া তালি দিতে হবে। কিন্তু তাও আবার পুরোনো বইয়ের দোকানেই ভিড়ব। মনে হবে, বইগুলোকে একটা ঘর দিচ্ছি, আর ওরা আমার ঘর হচ্ছে।
সেদিন পছন্দের সব লেখকের বই কেনা হল। মন খুব খুশি। একদম পাখির মত উৎফুল্লই বলা যায়। ফেরার পথে সে কি বৃষ্টি। কিভাবে যে বইগুলো আগলে বাড়ি ফিরেছি সে বলে আর কাজ নেই।
আজ পড়তে শুরু করলাম 'নাগলতা'। কিছু লাইনে থমকে গেলাম। এখানে একটু তুলে দেই। লেখা বড় হবে। কিন্তু তিন সেকেন্ড মনোযোগ ধরে রাখার দিনেও বিশাল বড় বড় লেখা পড়ার মত মানুষ আছে—এ আমি জানি। কারণ আমিই তাদের মধ্যে একজন।
লাইনগুলো কি চমৎকারই যে লাগল—
"লোকে জানে, প্রতিবেশীরাও শুনে আসছে, রোজই ঠিক সন্ধ্যার সময় বাড়ি ফিরে, ঠিক একইরকম একটি স্বস্তিময় স্বরে, ঠিক এইভাবেই ঘন্টি বাজিয়ে ডাক দিয়ে থাকেন এই ভদ্রলোকঃ আমি এসেছি নিরু।
ঘরের ভিতর থেকে লন্ঠন হাতে দরজার কাছে এগিয়ে আসেন নিরুপমা। মাঝে মাঝে নিরুপমাকেও কথা বলতে শোনা যায়। যেন একটু বেশি খুশী হয়ে আর হেসে কথা বলছেন নিরুপমা। —এত তাড়াতাড়ি ফিরলে যে? এখনও তো জোনাকি জ্বলে নি।
ভদ্রলোক হাসেন—আমি ঠিক সময়েই ফিরেছি। সন্ধ্যাটাই আসতে একটু দেরি করেছে।
সেই ভোজপুরী হালুয়াই রামসিংহাসন আজও বেঁচে আছে। রামসিংহাসন জানে, বাঙালীবাবু আজ পঁয়ত্রিশ বছর ধরে ঠিক সন্ধ্যার সময় বাড়ি ফিরে এসে আর দরজার কাছে দাঁড়িয়ে সাইকেলের ঘন্টি বাজিয়েছেন, আর, বউকে নাম ধরে ডেকেছেন।
আজকাল অর্থাৎ এই পাঁচ বছর ধরে বাঙালীবাবু কিন্তু মাঝে মাঝে অন্য একটা নাম ধরেও ডাকেন—আমি এসেছি নন্দু।
ঘরের ভিতর থেকে লন্ঠন হাতে নিয়ে দরজার কাছে এগিয়ে আসে সুনন্দা। সুনন্দাকেও মাঝে মাঝে বলতে শোনা যায়—আজ কিন্তু একটু দেরি করেছ বাবা।
রামসিংহাসন শুনতে পায়, বাঙালীবাবু তাঁর মেয়ের সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলছেন—আমার দেরি হয় নি নন্দু, সন্ধ্যাটাই একটু তাড়াতাড়ি ঘনিয়ে গেছে।"
এই তো! আজ বইয়ের গল্পের ইতি এখানেই টানলাম। ছুটি শেষের দিকে। কিভাবে কিভাবে দিনগুলো কেটে গেলো! অথচ, কত কিছুই না করার ছিল এই ছুটিতে। তার কতটুকুই বা হল। দিন তো কেটে গেলোই, কিন্তু ওই যে, এত অদ্ভুত এই জীবন যে " সন্ধ্যা কাটনা, অথচ দিব্যি বছর কেটে যাচ্ছে।" নাহলে, আজ কেন ১০ ই জুন। বছর ২০২৫। একটু আগে দেখলাম সকাল, এখন দেখি বারোটা বেজে ছয় মিনিট হয়ে গেল। ওদিকে সন্ধ্যা বেলা গিয়ে মনে হবে, ঘড়ির কাটা নড়ছে না।
অনেক দিন গালিব পড়ি না। গালিব না পড়ে এ কেমন ছুটি কাটাচ্ছি? ছুটতে হবে শাহজাহান মামার দোকানে। যদি পাওয়া যায় কিছু বই। যাদের লেখক মান্টো, গালিব, রুমি, কৃষণ চন্দর।🍃